03 June 2016

সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা | মুহম্মদ জাফর ইকবাল





আমি মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন শুনতে পাই, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি কী কাজ করছে?’ প্রশ্নটা শুনে আমি সব সময়েই অবাক হয়ে যাই এবং এর উত্তরে কী বলব বুঝতে পারি না। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘রাত্রে ঘুমানোর পদ্ধতি কী কাজ করছে’ তাহলে আমি যেরকম বুঝতে পারি না কী উত্তর দেব এটাও সেরকম! এর থেকেও বেশি অবাক হই যখন শুনি কেউ বলছে, ‘পড়ালেখার পদ্ধতি যদি সৃজনশীল না হয় তাহলে সৃজনশীল প্রশ্ন কাজ করবে কেমন করে?’ এই প্রশ্নটি শুনলে বুঝতে পারি যিনি প্রশ্ন করছেন তিনি ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ নয় লেখাপড়ার বিষয়টিই ধরতে পারেননি! কেন আমি এরকম একটি কথা বলছি সেটাও একটু বোঝানোর চেষ্টা করি।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নামটি দিয়ে শুরু করা যাক। যখন এটা শুরু করা হয়েছিল তখন এর নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। এর অর্থ পরীক্ষার প্রশ্নগুলো একটা কাঠামো বা স্ট্রাকচারের মাঝে করা হবে। আগে যে কোনো এক ধরনের কাঠামোর ভেতরে ছিল না তা নয়, তবে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নটি আরো বেশি কাঠামোর ভেতরে থাকবে, তাহলে প্রশ্ন তৈরি করাও সহজ হবে, মূল্যায়নও সহজ হবে।
যখন এই পদ্ধতি চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হল তখন অভিভাবকেরা উঠে পড়ে লাগলেন এটাকে বন্ধ করার জন্যে! তাদের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার, ‘পদ্ধতিটি অত্যন্ত ভালো, তবে আমাদের ছেলেমেয়েরা পাশ করে বের হয়ে যাক, তখন এটি চালু করা হোক!’ আমরা কয়েকজন তখন এই পদ্ধতিটির পক্ষে কথা বলেছি এবং সে কারণে আমাদের নিয়ে কমিটি ইত্যাদি তৈরি করে দেয়া হল। সেই কমিটির কয়েকজনের কাছে মনে হল ‘কাঠামোবদ্ধ’ শব্দটা প্রাণহীন এবং যান্ত্রিক, লেখাপড়ার এতো সুন্দর একটা পদ্ধতির এরকম খটমটে একটা নাম থাকা ঠিক হবে না এবং প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ‘কাঠামোবদ্ধ’ নামটা পরিবর্তন করে সেটাকে বলা হল ‘সৃজনশীল’! এই নামটা সৃজনশীল না হয়ে ‘সার্বজনীন’ হতে পারতো, ‘শিক্ষার্থী বান্ধব’ হতে পারতো কিংবা ‘আধুনিক’ও হতে পারতো। এমনকি বেঞ্জামিন ব্লুম নামে যে শিক্ষাবিদের বিশ্লেষনকে ভিত্তি করে এই পদ্ধতি গড়ে উঠেছে তার নামানুসারে ‘ব্লুম পদ্ধতি’ও হতে পারতো। (আমার ধারণা এই দেশের মানুষের সাদা চামড়া এবং বিদেশি মানুষের জন্যে এক ধরনের আলগা সমীহ আছে তাই ব্লুম পদ্ধতি নাম দেয়া হলে কেউ এর সমালোচনা করার সাহস পেতো না!)
কাজেই কেউ যখন জিজ্ঞেস করে সৃজনশীল পদ্ধতিতে লেখাপড়া না করালে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া হবে কেমন করে, তখন আমি কৌতুক অনুভব করি। ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করি।
একটা ছেলে বা মেয়ে যখন লেখাপড়া করে তখন তার মূল্যায়ন করার জন্য তাকে কিছু প্রশ্ন করতে হয়। আমি যদি বোকা-সোকা মানুষ হই তাহলে আমার প্রশ্নটাও হবে বোকা-সোকা! অর্থাৎ আমি এমন কিছু জানতে চাইব যার উত্তর দিতে হলে ছেলেটা বা মেয়েটাকে কিছু জিনিস মুখস্থ করে রাখতে হবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল কত সালে? কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছিল কত সালে? ইলেকট্রনের ভর কত? পারদের ঘনত্ব কত? ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মুখস্থ করার ক্ষমতাটা কোনো কিছু শেখার মূল ক্ষমতা নয়-( কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়া আর নকল করে পরীক্ষা দেয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই) কাজেই শুধু মুখস্থ জ্ঞান পরীক্ষা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে যেন আমরা জানতে পারি ছেলে বা মেয়েটা বিষয়টা আসলেই বুঝেছে কী না, বিষয়টা ব্যবহার করতে পারে কী না কিংবা বিষয়টা নিয়ে একেবারে নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারে কি না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিটি আসলে এই বিষয়টা নিশ্চিত করে। এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করলে আমরা একটা ছেলে বা মেয়ে সত্যি সত্যি একটা বিষয় শিখেছে কি না সেটা সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি। বিষয়টা আরো খোলসা করার জন্যে একটা সত্যিকারের উদাহরণ দেয়া যাক।
ধরা যাক একজন একটা পাঠ্য বিষয় পড়ে জানতে পারল বাংলাদশের জনসংখ্যা হচ্ছে ষোল কোটি। এখন আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করি ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত?’ সে ঝটপট বলে দিতে পারবে ‘ষোলকোটি’ যে বিষয়টি পড়েনি এবং এই সংখ্যাটি জানে না তার পক্ষে চিন্তা ভাবনা করে কোনোভাবেই এটা বের করা সম্ভব না, এটা জানার জন্যে তাকে বিষয়টা পড়তেই হবে, পড়ে মনে রাখতে হবে, সোজা কথায় মুখস্ত করতে হবে। এক অর্থে বলা যায় এই প্রশ্নটা করে আমি ছেলে বা মেয়েটার ‘মুখস্থ’ জ্ঞান পরীক্ষা করছি। সৃজনশীল পদ্ধতিতে এই ধরনের প্রশ্নের জন্যে থাকে মাত্র এক মার্ক! কিন্তু এই একটি মার্ক সে কখনোই এমনি এমনিভাবে পেয়ে যাবে না- এটা পাবার জন্যে তাকে তার পাঠ্য বিষয়টুকু পড়তে হবে।
ছেলে বা মেয়েটি সঠিক উত্তর দিলেও আমরা কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি সে বিষয়টা বুঝেছে কি না! হয়তো সংখ্যাটি না বুঝেই মুখস্ত করে রেখেছে! সত্যি সত্যি বুঝেছে কি না পরীক্ষা করার জন্যে আমাদের আরেকটা প্রশ্ন করতে হবে। অনেকভাবেই এটা করা সম্ভব, কিন্তু আমরা খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলাদেশে আনুমানিক কতোজন মহিলা?’
আমরা ধরে নিচ্ছি এই তথ্যটি পাঠ্য বিষয়ে দেয়া নেই, কাজেই এটা বের করার জন্যে তাকে একটুখানি চিন্তা করতে হবে। জনসংখ্যা বলতে কী বোঝায় তা জানতে হবে, কোনো গুরুতর কারণ না থাকলে যে একটা দেশে পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা কাছাকাছি হয় সেটাও জানতে হবে। কাজেই ছেলে বা মেয়েটি জনসংখ্যার বিষয়টি কোনো কিছু না বুঝে একেবারে তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে না থাকলে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারবে, বলতে পারবে, ‘আনুমানিক আট কোটি’ আমরা তখন জানব সে বিষয়টা বুঝেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোনো কিছু বুঝেছে কি না সেই প্রশ্নের জন্যে থাকে দুই মার্কস!
পড়ালেখা শেখার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াতে একটা ছেলে বা মেয়েকে কোনো কিছু শিখতে হলে তাকে তার জ্ঞানটুকু ব্যবহার করা শিখতে হয়। কাজেই এবারে তাকে এমন একটা প্রশ্ন করতে হবে যেটা থেকে আমরা জানতে পারব সে তার জ্ঞানটুকু ব্যবহার করতে শিখেছে কি না। এর জন্যে অনেক ধরনের প্রশ্ন করা সম্ভব, আবার আমি খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘উনিশ’শ সত্তর সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি, দুই হাজার পনের সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ষোল কোটি। দুই হাজার কুড়ি সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে?’’ বোঝাই যাচ্ছে এর উত্তর দিতে হলে তাকে ছোট খাটো একটা হিসাব করতে হবে।
হিসাব করে সে যদি বের করতে পারে সংখ্যাটি হবে সতেরো কোটি তাহলে বুঝতে হবে সে মোটামুটিভাবে সঠিক হিসাব করেছে। কোনো ছেলে বা মেয়ে তার জ্ঞানটুকু ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে কি না সেটা পরীক্ষা করার এ রকম আরো অনেক ধরনের দক্ষতা রয়েছে। যদি আমরা প্রশ্ন করে বুঝতে পারি তার প্রয়োজনীয় দক্ষতাটুকু আছে তাহলে সৃজনশীল পদ্ধতিতে ছেলেটি বা মেয়েটি পাবে আরো তিন মার্কস। অর্থাৎ জানা বোঝা এবং ব্যবহার করতে পারার দক্ষতা এই তিনটি মিলিয়ে তাকে ছয় মার্কসের মূল্যায়ন করা হয়েছে। যদি আমরা সব মিলিয়ে দশ মার্কসের মূল্যায়ন করতে চাই তাহলে আরো চার মার্কস এর একটি প্রশ্ন করতে হবে। শেষের চার মার্কস এর প্রশ্নটিই হচ্ছে একমাত্র বা সত্যিকারের ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন।
এই্ শেষ প্রশ্নটির গালভরা নামটি হচ্ছে ‘উচ্চতর দক্ষতা’, এই প্রশ্নটি দিয়ে আমরা বুঝতে পারি ছেলে বা মেয়েটির মৌলিকভাবে চিন্তা-ভাবনা বা বিশ্লেষন করার ক্ষমতা আছে কী নেই। আমাদের এই প্রশ্নগুলোর সাথে মিল রেখে একটা সহজ উদাহরণ এরকম হতে পারে, ‘দেশের মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়ার সাথে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কী না সেটা ব্যাখ্যা কর।’ বোঝায় যাচ্ছে এর উত্তর দিতে হলে তাকে বেশ মাথা খাটাতে হবে। সে নিজের মতো করে চিন্তা ভাবনা করে যুক্তি দিয়ে এর যা খুশি উত্তর দিতে পারে। কেউ যদি সঠিক যুক্তি দিয়ে বলে সম্পর্ক আছে তাহলেও সে চার মার্কস পেতে পারে, আবার যদি যুক্তি দিয়ে উল্টোটা বোঝাতে পারে তাহলেও চার মার্কস পেতে পারে!
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্ন আসলে এমন কিছু হাতি ঘোড়া বিষয় নয়, একটু গুছিয়ে প্রশ্ন করার পদ্ধতি। আমি এই আলোচনার মাঝে শুধু ‘উদ্দীপক’ নামের অংশটুকু নিয়ে কিছু বলিনি। ছেলে-মেয়েদের খেই ধরিয়ে দেয়ার জন্য কোনো একটা কিছু দিয়ে শুরু করে তারপর প্রশ্নগুলো লেখা হয়, তার বেশি কিছু নয় সেটাই হচ্ছে উদ্দীপক। উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন করার সময় উদ্দীপকের সাথে একটু মিল রেখে প্রশ্নটা করতে হয়।
যাই হোক, সবাইকে বুঝতে হবে সৃজনশীল পদ্ধতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার অনেক আগে থেকেই কিন্তু ভালো শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করে আসছেন, শুধু আমরা সেগুলোকে এই নামে ডাকিনি! এখন আমরা বিষয়টা আনুষ্ঠানিকভাবে করছি, একটা কাঠামোর ভেতরে করছি সেটুকুই হচ্ছে পার্থক্য।
ভালো প্রশ্নের ধরনই হচ্ছে আমাদের সৃজনশীল প্রশ্ন, এই প্রশ্নগুলো করে একটা ছেলে বা মেয়েকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব। এটা বাংলাদেশের শিক্ষাবিদেরা আবিষ্কার করেননি, সারা পৃথিবীর ছাত্র ছাত্রীদেরকেই এই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা এখন এটা শুরু করেছি। কাজেই কেউ যখন প্রশ্ন করে, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি কী কাজ করছে?’ তখন আসলে সে জানতে চাইছে, ‘একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে সার্বিক প্রশ্ন করার কাজটি কি ঠিক হচ্ছে?’ তাই আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারি না!
২.
সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার দুটো মজার ঘটনার কথা মনে পড়ল। তখন মাত্র এটি শুরু হয়েছে, শিক্ষকেরা বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি। আমার বোনের মেয়ে যে স্কুলে পড়ে তার ধর্ম শিক্ষক সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন, সৃজনশীল প্রশ্নের মাথা-মুণ্ডু কিছুই তিনি ধরতে পারেন না। কোনো উপায় না পেয়ে পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীদের বললেন, ‘তোরা সবাই বাসা থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন করে আনবি, যারটা সবচেয়ে ভালো হবে সেটা পরীক্ষায় দিয়ে দেব!’ ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেখে কে! যে প্রশ্ন করতে গিয়ে শিক্ষকের মাথা ওলট-পালট হয়ে যায় সেই বিষয় নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বুকের ভেতর কিন্তু কোনো ভয় ডর নেই।
দ্বিতীয় ঘটনাটি শুনেছি একজন শিক্ষকের কাছে। একদিন আমাকে বললেন, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পর কী ঘটেছে জানেন?’ আমি বললাম ‘কী ঘটেছে?’ শিক্ষক বললেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে, দোজখ আর বেহেশতের মাঝে পার্থক্য কী? একজন ছেলে লিখেছে, দোজখ হচ্ছে ‘মাইর’ এবং ‘মাইর’! বেহেশত হচ্ছে আ-রা-ম!’ আমি হাসতে হাসতে শিক্ষককে বললাম, ‘আপনি তাকে পুরো মার্কস দিয়েছেন তো? সে কিন্তু পার্থক্যটা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে!’
৩.
স্কুলের শিক্ষকেরা যেন সার্বিকভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন সে জন্যে তাদের অনেক ট্রেনিং দেয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও মনে হয় বেশির ভাগ শিক্ষক বিষয়টা ঠিকভাবে ধরতে পারেননি। একেবারে হুবহু নিয়ম মেনে প্রশ্ন না করলেই যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে তাও নয়। গৎবাধা নিয়ম মেনে প্রশ্ন করলেই কাজ চালানোর মতো প্রশ্ন করা সম্ভব কিন্তু যে কোনো কারণেই তাদের মাঝে সেই আত্মবিশ্বাসটুকু গড়ে তোলা যায়নি। তাই ধীরে ধীরে শিক্ষকেরা গাইড বই থেকে প্রশ্ন নেয়া শুরু করলেন। ছাত্রছাত্রীরা যখন বিষয়টা টের পেতে শুরু করল তখন ভালো মার্কস পাওয়ার লোভে তারাও গাইড বই পড়তে শুরু করল। আগে তারা শুধু পাঠ্যবই মুখস্থ করতো এখন তাদের পাঠ্য বই এবং গাইড বই দুটোই মুখস্থ করতে হয়।
সরকার থেকে গাইড বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি এটা অন্য নামে ছাপা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের এর জন্যে যতটুকু চাহিদা অভিভাবকদের চাহিদা তার থেকে দশগুণ বেশি, কাজেই বাজার থেকে গাইড বই উঠে যাবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই! সবচেয়ে বড় কথা গাইড বই ছাপিয়ে টু পাইস কামিয়ে নেবার ব্যবসা শুধু যে গাইড বইয়ের বিক্রেতারা করছেন তা নয়- আমাদের দেশের সব বড় বড় দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়মিত গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ঘুম নেই, তীব্র সমালোচনা করে বড় বড় প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে কিন্তু নিজেরা কেমন করে এতো বড় একটা অন্যায় কাজ করে ছেলে মেয়েদের নিপীড়ন করে যাচ্ছেন সেটা কিছুতেই আমি বুঝতে পারি না। প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে রাখা লেখাপড়া নয়- এই সহজ বিষয়টা দেশের বড় বড় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকেরা জানেন না, এই দুঃখটি রাখার জায়গা নেই।
স্কুলের শিক্ষকেরা যখন গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিয়ে স্কুলের পরীক্ষা নিতে শুরু করলেন তখন অসংখ্য ছেলে-মেয়ে আমার কাছে সেটা নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেছিল। আমি তাদেরকে বুঝিয়েছিলাম তারা যেন সেটা নিয়ে মাথা না ঘামায়! তারা যেন ভালো করে তাদের পাঠ্য বইটি পড়েই পরীক্ষা দেয়। তার কারণ গাইড বই মুখস্থ করে স্কুলের পরীক্ষাতে ভালো মার্কস পেয়ে কোনো লাভ হবে না। সত্যিকারের পাবলিক পরীক্ষাতে কখনোই গাইড বই থেকে কোনো প্রশ্ন আসবে না কাজেই কোনোভাবেই তারা যেন গাইড বই মুখস্থ করে নিজেদের সৃজনশীলতা নষ্ট না করে।
তখন একদিন সৃজনশীল পদ্ধতির মাঝে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ল আমরা হতবুদ্ধি হয়ে আবিষ্কার করলাম দেশের পাবলিক পরীক্ষাতে গাইড বই থেকে প্রশ্ন দেয়া শুরু হয়েছে। এর চাইতে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে, আমার জানা নেই। যে প্রশ্নপত্রে পনেরো থেকে বিশ লক্ষ ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দেবে সেই প্রশ্ন যদি শিক্ষকেরা নিজে করতে না পারেন তাহলে আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব?
কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বড় সভায় আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল, সেখানে দেশের অনেক বড় বড় শিক্ষাবিদেরা উপস্থিত ছিলেন। কেমন করে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে সেখানে অনেক আলোচনা হয়েছে। যারা আলোচনা করেছেন তাদের মাঝে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যেয়ের শিক্ষকেরাই বেশি ছিলেন, মাঠ পর্যাপয়ে স্কুলের শিক্ষকেরা কেউ ছিলেন না- তাই আলোচনাটুকু ঠিক বাস্তবমুখী না হয়ে অনেকটা দার্শনিক আলোচনার মতো হয়েছিল, তারপরেও আমি ব্যক্তিগতভাবে খু্বই আনন্দিত হয়েছি যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যবন্ত শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে!
তবে শেষ খবর অনুযায়ী, এই অঞ্চলের যতগুলো দেশ রয়েছে তার মাঝে বাংলাদেশ শিক্ষার পেছনে সবচেয়ে কম অর্থ খরচ করে। যেখানে জিডিপি এর ছয় শতাংশ খরচ করার কথা সেই সংখ্যাটি কমতে কমতে এখন দুই শতাংশ থেকেও নিচে নেমে এসেছে। কী সর্বনাশা কথা!
যেই দেশে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে কম সেই দেশের ছেলেমেয়েদের হাতে আমরা কী তুলে দেব? এই দুঃখ আমরা কোথায় রাখব?

Source:  (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম আপডেট: ২০১৬-০৬-০৩)
Unknown Web Developer

Morbi aliquam fringilla nisl. Pellentesque eleifend condimentum tellus, vel vulputate tortor malesuada sit amet. Aliquam vel vestibulum metus. Aenean ut mi aucto.

01 June 2016

সত্য, ন্যায়, সৌজন্যবোধ ও দলীয় পরিচয়


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য লন্ডনে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আজ (মঙ্গলবার) লন্ডনের প্রিন্সেস গ্রেস হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। নওয়াজ শরিফের ওপেন হার্ট সার্জারির সংবাদ অবগত হয়ে শনিবার টুইট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সাহেবের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে, তাঁর জন্য শুভকামনা রইল। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন ও সুস্বাস্থ্য লাভ করুন।’
দুটি রাষ্ট্রের নেতারা এবং কর্মকর্তারা ৬৯ বছর যাবৎ অব্যাহত বাগ্যুদ্ধে রত। কিছুকাল আগে কারগিলেও ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গেছে। পুরো মাত্রায় যুদ্ধ করেছে তিনবার। তারপরেও নেতাদের পর্যায়ে পারস্পরিক সৌজন্য প্রকাশে কখনো কার্পণ্য লক্ষ করা যায়নি। একজন সংস্কৃতিমান ব্যক্তি যে পেশায়ই থাকুন না কেন, যে পদেই আসীন হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি মানুষ। এবং মানুষের বিচার হয় তার মানবিক গুণ দিয়ে, তাঁর পেশাগত দক্ষতা-যোগ্যতা বিচারের জায়গা আলাদা। 
রাজনীতি করা মানে সত্য, ন্যায়, সৌজন্যবোধ ও মানবিক গুণ বিসর্জন দিয়ে তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য অথবা প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য যা খুশি তা-ই করা নয়। উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী যখন ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করছিলেন, তখনো বলেছেন, ‘আমি সরকারের শত্রু নই, বরং আমি সরকারের বন্ধু।’ তাঁর দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যই তাঁকে আন্দোলন করতে হয়, তা ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো, ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রশ্নই আসে না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ব্রিটিশরাজের জন্য ত্রাস। তিনিও বাংলার গভর্নরকে বিশেষ উপলক্ষে উপহার পাঠিয়েছেন। খুব বড় নেতারা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকেন। বরং বলা ভালো, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকেন বলেই তাঁরা বড় ও মহৎ নেতা হয়ে ওঠেন। 
বাংলাদেশের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে, যেখানে নিজের দলের বাইরে অন্য দলের বিশেষ করে প্রতিপক্ষের কেউ মারা গেলেও কেউ দুঃখ পান না। সামাজিকতার খাতিরে শোক প্রকাশ করা যে রীতি, সে কথা পর্যন্ত ভুলে গেছেন আমাদের নেতারা। গত পাঁচ-সাত বছরে দেশের সরকারপন্থী ও বিরোধীদলীয় জনা পনেরো বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেছেন। আওয়ামী লীগপন্থী যত বড় মানুষই মারা যান বিএনপির নেতারা তাঁর মৃত্যুতে দুই বাক্যের শোকবার্তা পাঠাননি তাঁর পরিবারের কাছে অথবা সংবাদমাধ্যমের অফিসে। বিএনপির কোনো নেতা বা ওই ঘরানার কোনো কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী ইন্তেকাল করলে সরকারি নেতারা শোক প্রকাশ করেন না। সম্ভবত তাঁরা বলবেন, আমরা শোক পাইনি বলেই শোক প্রকাশ করিনি। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দিতে পারি। গারো সম্প্রদায়ের নেতা ও খ্যাতিমান রাজনীতিক প্রমোদ মানকিন মারা গেলেন। বিএনপির চেয়ারপারসন বা অন্য কোনো নেতা তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, তেমন কোনো খবর কাগজে চোখে পড়েনি। তিনি এই সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাতে হলোটা কী? তিনি তো একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
কয়েক দিন আগে আকস্মিকভাবে মারা গেলেন সাদেক খান। আমি তাঁর নামটিই শুধু বললাম, পরিচয় দিতে গেলে অনেকগুলো বিশেষণ প্রয়োজন হবে। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ইংরেজি ও বাংলা দুটি ভাষাতেই অসামান্য দক্ষ। তাঁর কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। সরকারি লোক এবং এ প্রজন্মের মানুষ তাঁকে জানে বিএনপি ঘরানার একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তা কেউ একজন হতেই পারেন।
আমরা যখন প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির কথা বলব, বিশেষ করে সেই পাকিস্তানি আমলের, তখন সাদেক খানের নাম আসবে প্রথম সারিতে। আমরা যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস পাঠ করব, সেখানে সাদেক খানের নাম বড় হরফে লেখা দেখব। এখন যারা ‘তোরে খামু’ অথবা ‘বউয়ের ভাই হউরের পো’-জাতীয় ছবির সঙ্গে পরিচিত, তাদের নদী ও নারী ছবিটি সম্পর্কে বলতে যাওয়া বোকামি। ভারতীয় লেখক, শিক্ষাবিদ ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের উপন্যাস নদী ও নারীর কাহিনি অবলম্বনে ছবিটি তৈরি। মুক্তি পায় ১৯৬৫-র জুলাইয়ে। প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন সাদেক খান। তিনি উপন্যাসটির চিত্রনাট্য করে সোজা চলে যান দিল্লিতে লেখকের অনুমতি নিতে। মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের সরকারি বাসভবনে গিয়ে তাঁর অনুমতি নেন এবং তাঁর হাতে গুঁজে দেন কিছু পাউন্ড-স্টার্লিং। তিনি অবাক হন পূর্ব বাংলার এক তরুণের উৎসাহ দেখে। 
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম পর্যায়ের নক্ষত্রদের একজন সাদেক খান। সত্যজিৎ রায় প্রভাবিত শিল্পঋদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণের পথনির্মাতাদের তিনি একজন। সে সময়ের এ জে কারদার, ফতেহ লোহানী, মহিউদ্দিন, জহির রায়হান, সাদেক খান প্রমুখ যে ধারা তৈরি করেন, তা যদি স্বাধীনতার পরে অবিকৃত থাকত, বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পেত। নদী ও নারীতে তিনি আসামের নায়িকা ইভা আচরীকে এনেছিলেন। 
চিত্রশিল্পের সাদেক খান ছিলেন একজন বিদগ্ধ সমঝদার। ইংল্যান্ডে বহুদিন থাকায় তাঁর আন্তর্জাতিক মানের একটি রুচি তৈরি হয়েছিল। চিত্রসমালোচক হিসেবে তাঁর মতামতের মূল্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরীও দিয়েছেন। তিনি ছিলেন একটি সংস্কৃতিমান পরিবারের সন্তান। তাঁরা ভাইবোনেরা সবাই প্রতিভাবান এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও সাদেক খান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর রসগ্রাহিতা ও বৈদগ্ধের সঙ্গে তুলনীয় মানুষ আমার জানাশোনার মধ্যে খুব বেশি দেখিনি। আমাদের সমাজে নিম্ন-মাঝারিরই রাজত্ব। সেখানে তিনি ছিলেন পরিশীলিত ও সুশিক্ষিত। তাঁর শেষের দিকের রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীত যাঁরা, তাঁদের সঙ্গেও তিনি অত্যন্ত সৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর প্রতিদান পাননি। 
শিল্প-সংস্কৃতির জগতে কিছুই যদি না করতেন সাদেক খান, শুধু ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর যে ভূমিকা, তার জন্যই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনেক বীর ভেবেচিন্তে নভেম্বরের শেষ দিকে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সাদেক খান একাত্তরের মার্চের বেশ আগে থেকেই তাঁর লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির পটভূমি তৈরি করেন। বিশ্বজনমত গঠনে প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে তিনি যে ভূমিকা রাখেন, তার সাক্ষ্য তখনকার কাগজপত্রে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান মানুষ। কোনো কাজেরই প্রতিদানের প্রত্যাশা করেননি। যাঁরা অব্যাহত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তাঁরা কেউই তাঁর মৃত্যুতে মামুলি শোকটাও প্রকাশ করেননি। তাঁর জানাজায় দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি দল বা জোটের কেউ অংশগ্রহণ করেননি। একসময় প্রেসক্লাবে তিনি খুবই যেতেন এবং বয়স ও দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার সঙ্গেই আড্ডা দিতেন। কিন্তু বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম, মিডিয়া জগতেও তাঁর মতো বন্ধুবৎসল মানুষ অনেকটাই বন্ধুহীন। কারণ, দলীয় রাজনীতি।
একটি রাষ্ট্র শুধু সরকারি দলের লোক নিয়ে গঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্মান, ভালোবাসা ও আনুকূল্য পাওয়ার অধিকার ও যোগ্যতা শুধু সরকার-সমর্থকদের নয়। রাষ্ট্রের পদক-পুরস্কার তাঁরা পাবেন, সেটা খুব ভালো কথা। অসুখবিসুখ হলে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অর্থ সাহায্য তাঁরাই বেশি পাবেন, তাতেও কারও অন্তর্দাহের কারণ নেই। সরকার দানছত্র খুলে বসলে মন্দ কী? কিন্তু ভিন্নমতের কেউই কিছু পাবেন না, সেটা চরম অবিচার। রাষ্ট্র দলীয় লোকদের জন্য যে টাকা দুহাতে খরচ করে, তা কোনো দলের বা গোষ্ঠীর উপার্জিত টাকা নয়। জনগণের করের টাকা। সে টাকা শুধু দলীয় লোকদের দেওয়ার অধিকার কোনো সরকারের নেই। সমর্থকদের অসুখ-আজারির নামে মুড়ি-মুড়কির মতো টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।
চাষী নজরুল ইসলাম অনেক দিন ক্যানসারে ভুগে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় মারা গেলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে চাষী নজরুলের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন না, অন্য দল পছন্দ করতেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রে সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্মে আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছু দেখা যায় না। সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে ছিল না। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি তাঁর কিছুমাত্র পক্ষপাত ছিল না। তিনি যে দলই করুন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা তিনি ধারণ করতেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের তিনি কখনোই অসম্মান করেননি। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত অবস্থায় তিনি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকদের থেকে যেমন কোনো আনুকূল্য অথবা অর্থ সাহায্য তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ সহানুভূতিও পাননি, মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বলতে যা বোঝায়, যা দিতে পয়সা লাগে না, তা থেকেও হয়েছেন বঞ্চিত। 
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে সুভাষ দত্ত ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন নীতিবাদী মানুষ। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনের রাস্তায়। বাড়িটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এ বাড়িতে কত ইতিহাস!’ চমৎকার মানুষ ছিলেন। অনেকক্ষণ কথা হলো। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার কোন কুক্ষণে বেগম রোকেয়ার ওপর কথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিল। সেই পাপ থেকে আমৃত্যু তাঁর মুক্তি ঘটেনি। সে বেদনা ছিল তাঁর অথচ আজীবন তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী কিন্তু অরাজনৈতিক মানুষ। 
ভিন্নমতের কেউ মন্ত্রিত্ব চায় না। রাষ্ট্রদূত হতে চায় না। বিদেশে সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে থাকতে চায় না, এমনকি তার নাগরিক অধিকার বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচলে প্লট পাওয়া, তাও চায় না। বিনা পয়সায় সামান্য সম্মান ও মর্যাদা, তাও যদি না পায়, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
যে সমাজে মানুষ পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয় বড়, মানবিক সম্পর্কের চেয়ে দলীয় সম্পর্ক প্রাধান্য পায়, যেখানে প্রতিপক্ষকে যুক্তি দিয়ে পরাস্ত না করে মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘায়েল করা হয়, ফরমাশমতো ফরেনসিক রিপোর্ট লেখা হয়, সে সমাজের সঙ্গে আদিম বর্বর সমাজের পার্থক্য কোথায়? যেখানে সত্য, ন্যায়বিচার, সৌজন্যবোধ নেই, সে দেশ মধ্যম আয়ের হলেই কী আর বিরাট ধনী হলেই কী, তা কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নয়। 


সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
তথ্যসূত্রওঃ প্রথম আলো (মে ৩১, ২০১৬)
Unknown Web Developer

Morbi aliquam fringilla nisl. Pellentesque eleifend condimentum tellus, vel vulputate tortor malesuada sit amet. Aliquam vel vestibulum metus. Aenean ut mi aucto.