01 June 2016

সত্য, ন্যায়, সৌজন্যবোধ ও দলীয় পরিচয়


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য লন্ডনে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আজ (মঙ্গলবার) লন্ডনের প্রিন্সেস গ্রেস হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হবে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। নওয়াজ শরিফের ওপেন হার্ট সার্জারির সংবাদ অবগত হয়ে শনিবার টুইট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সাহেবের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে, তাঁর জন্য শুভকামনা রইল। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন ও সুস্বাস্থ্য লাভ করুন।’
দুটি রাষ্ট্রের নেতারা এবং কর্মকর্তারা ৬৯ বছর যাবৎ অব্যাহত বাগ্যুদ্ধে রত। কিছুকাল আগে কারগিলেও ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গেছে। পুরো মাত্রায় যুদ্ধ করেছে তিনবার। তারপরেও নেতাদের পর্যায়ে পারস্পরিক সৌজন্য প্রকাশে কখনো কার্পণ্য লক্ষ করা যায়নি। একজন সংস্কৃতিমান ব্যক্তি যে পেশায়ই থাকুন না কেন, যে পদেই আসীন হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি মানুষ। এবং মানুষের বিচার হয় তার মানবিক গুণ দিয়ে, তাঁর পেশাগত দক্ষতা-যোগ্যতা বিচারের জায়গা আলাদা। 
রাজনীতি করা মানে সত্য, ন্যায়, সৌজন্যবোধ ও মানবিক গুণ বিসর্জন দিয়ে তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য অথবা প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য যা খুশি তা-ই করা নয়। উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী যখন ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করছিলেন, তখনো বলেছেন, ‘আমি সরকারের শত্রু নই, বরং আমি সরকারের বন্ধু।’ তাঁর দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যই তাঁকে আন্দোলন করতে হয়, তা ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো, ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রশ্নই আসে না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ব্রিটিশরাজের জন্য ত্রাস। তিনিও বাংলার গভর্নরকে বিশেষ উপলক্ষে উপহার পাঠিয়েছেন। খুব বড় নেতারা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকেন। বরং বলা ভালো, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকেন বলেই তাঁরা বড় ও মহৎ নেতা হয়ে ওঠেন। 
বাংলাদেশের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে, যেখানে নিজের দলের বাইরে অন্য দলের বিশেষ করে প্রতিপক্ষের কেউ মারা গেলেও কেউ দুঃখ পান না। সামাজিকতার খাতিরে শোক প্রকাশ করা যে রীতি, সে কথা পর্যন্ত ভুলে গেছেন আমাদের নেতারা। গত পাঁচ-সাত বছরে দেশের সরকারপন্থী ও বিরোধীদলীয় জনা পনেরো বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেছেন। আওয়ামী লীগপন্থী যত বড় মানুষই মারা যান বিএনপির নেতারা তাঁর মৃত্যুতে দুই বাক্যের শোকবার্তা পাঠাননি তাঁর পরিবারের কাছে অথবা সংবাদমাধ্যমের অফিসে। বিএনপির কোনো নেতা বা ওই ঘরানার কোনো কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী ইন্তেকাল করলে সরকারি নেতারা শোক প্রকাশ করেন না। সম্ভবত তাঁরা বলবেন, আমরা শোক পাইনি বলেই শোক প্রকাশ করিনি। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দিতে পারি। গারো সম্প্রদায়ের নেতা ও খ্যাতিমান রাজনীতিক প্রমোদ মানকিন মারা গেলেন। বিএনপির চেয়ারপারসন বা অন্য কোনো নেতা তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন, তেমন কোনো খবর কাগজে চোখে পড়েনি। তিনি এই সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাতে হলোটা কী? তিনি তো একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
কয়েক দিন আগে আকস্মিকভাবে মারা গেলেন সাদেক খান। আমি তাঁর নামটিই শুধু বললাম, পরিচয় দিতে গেলে অনেকগুলো বিশেষণ প্রয়োজন হবে। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ইংরেজি ও বাংলা দুটি ভাষাতেই অসামান্য দক্ষ। তাঁর কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। সরকারি লোক এবং এ প্রজন্মের মানুষ তাঁকে জানে বিএনপি ঘরানার একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তা কেউ একজন হতেই পারেন।
আমরা যখন প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির কথা বলব, বিশেষ করে সেই পাকিস্তানি আমলের, তখন সাদেক খানের নাম আসবে প্রথম সারিতে। আমরা যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস পাঠ করব, সেখানে সাদেক খানের নাম বড় হরফে লেখা দেখব। এখন যারা ‘তোরে খামু’ অথবা ‘বউয়ের ভাই হউরের পো’-জাতীয় ছবির সঙ্গে পরিচিত, তাদের নদী ও নারী ছবিটি সম্পর্কে বলতে যাওয়া বোকামি। ভারতীয় লেখক, শিক্ষাবিদ ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের উপন্যাস নদী ও নারীর কাহিনি অবলম্বনে ছবিটি তৈরি। মুক্তি পায় ১৯৬৫-র জুলাইয়ে। প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন সাদেক খান। তিনি উপন্যাসটির চিত্রনাট্য করে সোজা চলে যান দিল্লিতে লেখকের অনুমতি নিতে। মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরের সরকারি বাসভবনে গিয়ে তাঁর অনুমতি নেন এবং তাঁর হাতে গুঁজে দেন কিছু পাউন্ড-স্টার্লিং। তিনি অবাক হন পূর্ব বাংলার এক তরুণের উৎসাহ দেখে। 
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম পর্যায়ের নক্ষত্রদের একজন সাদেক খান। সত্যজিৎ রায় প্রভাবিত শিল্পঋদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণের পথনির্মাতাদের তিনি একজন। সে সময়ের এ জে কারদার, ফতেহ লোহানী, মহিউদ্দিন, জহির রায়হান, সাদেক খান প্রমুখ যে ধারা তৈরি করেন, তা যদি স্বাধীনতার পরে অবিকৃত থাকত, বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ মর্যাদার আসন পেত। নদী ও নারীতে তিনি আসামের নায়িকা ইভা আচরীকে এনেছিলেন। 
চিত্রশিল্পের সাদেক খান ছিলেন একজন বিদগ্ধ সমঝদার। ইংল্যান্ডে বহুদিন থাকায় তাঁর আন্তর্জাতিক মানের একটি রুচি তৈরি হয়েছিল। চিত্রসমালোচক হিসেবে তাঁর মতামতের মূল্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরীও দিয়েছেন। তিনি ছিলেন একটি সংস্কৃতিমান পরিবারের সন্তান। তাঁরা ভাইবোনেরা সবাই প্রতিভাবান এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও সাদেক খান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর রসগ্রাহিতা ও বৈদগ্ধের সঙ্গে তুলনীয় মানুষ আমার জানাশোনার মধ্যে খুব বেশি দেখিনি। আমাদের সমাজে নিম্ন-মাঝারিরই রাজত্ব। সেখানে তিনি ছিলেন পরিশীলিত ও সুশিক্ষিত। তাঁর শেষের দিকের রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীত যাঁরা, তাঁদের সঙ্গেও তিনি অত্যন্ত সৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর প্রতিদান পাননি। 
শিল্প-সংস্কৃতির জগতে কিছুই যদি না করতেন সাদেক খান, শুধু ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর যে ভূমিকা, তার জন্যই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনেক বীর ভেবেচিন্তে নভেম্বরের শেষ দিকে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সাদেক খান একাত্তরের মার্চের বেশ আগে থেকেই তাঁর লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির পটভূমি তৈরি করেন। বিশ্বজনমত গঠনে প্রবাসী সরকারের নেতাদের সঙ্গে তিনি যে ভূমিকা রাখেন, তার সাক্ষ্য তখনকার কাগজপত্রে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান মানুষ। কোনো কাজেরই প্রতিদানের প্রত্যাশা করেননি। যাঁরা অব্যাহত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তাঁরা কেউই তাঁর মৃত্যুতে মামুলি শোকটাও প্রকাশ করেননি। তাঁর জানাজায় দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি দল বা জোটের কেউ অংশগ্রহণ করেননি। একসময় প্রেসক্লাবে তিনি খুবই যেতেন এবং বয়স ও দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার সঙ্গেই আড্ডা দিতেন। কিন্তু বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম, মিডিয়া জগতেও তাঁর মতো বন্ধুবৎসল মানুষ অনেকটাই বন্ধুহীন। কারণ, দলীয় রাজনীতি।
একটি রাষ্ট্র শুধু সরকারি দলের লোক নিয়ে গঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্মান, ভালোবাসা ও আনুকূল্য পাওয়ার অধিকার ও যোগ্যতা শুধু সরকার-সমর্থকদের নয়। রাষ্ট্রের পদক-পুরস্কার তাঁরা পাবেন, সেটা খুব ভালো কথা। অসুখবিসুখ হলে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অর্থ সাহায্য তাঁরাই বেশি পাবেন, তাতেও কারও অন্তর্দাহের কারণ নেই। সরকার দানছত্র খুলে বসলে মন্দ কী? কিন্তু ভিন্নমতের কেউই কিছু পাবেন না, সেটা চরম অবিচার। রাষ্ট্র দলীয় লোকদের জন্য যে টাকা দুহাতে খরচ করে, তা কোনো দলের বা গোষ্ঠীর উপার্জিত টাকা নয়। জনগণের করের টাকা। সে টাকা শুধু দলীয় লোকদের দেওয়ার অধিকার কোনো সরকারের নেই। সমর্থকদের অসুখ-আজারির নামে মুড়ি-মুড়কির মতো টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।
চাষী নজরুল ইসলাম অনেক দিন ক্যানসারে ভুগে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় মারা গেলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে চাষী নজরুলের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন না, অন্য দল পছন্দ করতেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রে সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্মে আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী কোনো কিছু দেখা যায় না। সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে ছিল না। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি তাঁর কিছুমাত্র পক্ষপাত ছিল না। তিনি যে দলই করুন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা তিনি ধারণ করতেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের তিনি কখনোই অসম্মান করেননি। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত অবস্থায় তিনি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকদের থেকে যেমন কোনো আনুকূল্য অথবা অর্থ সাহায্য তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ সহানুভূতিও পাননি, মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বলতে যা বোঝায়, যা দিতে পয়সা লাগে না, তা থেকেও হয়েছেন বঞ্চিত। 
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে সুভাষ দত্ত ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন নীতিবাদী মানুষ। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনের রাস্তায়। বাড়িটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এ বাড়িতে কত ইতিহাস!’ চমৎকার মানুষ ছিলেন। অনেকক্ষণ কথা হলো। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার কোন কুক্ষণে বেগম রোকেয়ার ওপর কথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিল। সেই পাপ থেকে আমৃত্যু তাঁর মুক্তি ঘটেনি। সে বেদনা ছিল তাঁর অথচ আজীবন তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী কিন্তু অরাজনৈতিক মানুষ। 
ভিন্নমতের কেউ মন্ত্রিত্ব চায় না। রাষ্ট্রদূত হতে চায় না। বিদেশে সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে থাকতে চায় না, এমনকি তার নাগরিক অধিকার বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচলে প্লট পাওয়া, তাও চায় না। বিনা পয়সায় সামান্য সম্মান ও মর্যাদা, তাও যদি না পায়, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
যে সমাজে মানুষ পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয় বড়, মানবিক সম্পর্কের চেয়ে দলীয় সম্পর্ক প্রাধান্য পায়, যেখানে প্রতিপক্ষকে যুক্তি দিয়ে পরাস্ত না করে মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘায়েল করা হয়, ফরমাশমতো ফরেনসিক রিপোর্ট লেখা হয়, সে সমাজের সঙ্গে আদিম বর্বর সমাজের পার্থক্য কোথায়? যেখানে সত্য, ন্যায়বিচার, সৌজন্যবোধ নেই, সে দেশ মধ্যম আয়ের হলেই কী আর বিরাট ধনী হলেই কী, তা কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নয়। 


সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।
তথ্যসূত্রওঃ প্রথম আলো (মে ৩১, ২০১৬)
Unknown Web Developer

Morbi aliquam fringilla nisl. Pellentesque eleifend condimentum tellus, vel vulputate tortor malesuada sit amet. Aliquam vel vestibulum metus. Aenean ut mi aucto.

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.